বর্তমান ডিজিটাল যুগে স্মার্টফোন ব্যবহার করে অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে "ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম করার অ্যাপ" করার অ্যাপগুলো অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় মনে হয় । এই ধরনের অ্যাপ ব্যবহারকারীদের নির্দিষ্ট কিছু ভিডিও দেখার বিনিময়ে অর্থ বা অন্য কোনো পুরস্কার প্রদান করে।
ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম: এটি কীভাবে কাজ করে?
ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম করার অ্যাপগুলোর মূল ধারণা হলো, ব্যবহারকারীরা যখন অ্যাপের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও (যেমন – বিজ্ঞাপন, পণ্যের রিভিউ, মুভি ট্রেইলার, গানের ভিডিও, ছোট ছোট ক্লিপ ইত্যাদি) দেখেন, তখন অ্যাপ কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপনদাতা বা কনটেন্ট প্রোভাইডারদের কাছ থেকে অর্থ পায়। সেই আয়ের একটি অংশ তারা ব্যবহারকারীদের পুরস্কার হিসেবে প্রদান করে।
এই অ্যাপগুলোর কার্যপ্রণালী সাধারণত নিম্নরূপ:
অ্যাপ ডাউনলোড ও রেজিস্ট্রেশন: ব্যবহারকারীকে প্রথমে গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপ স্টোর থেকে নির্দিষ্ট অ্যাপটি ডাউনলোড করে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হয়।
ভিডিও দেখা: অ্যাকাউন্টে লগইন করার পর ব্যবহারকারীরা অ্যাপে উপলব্ধ বিভিন্ন ভিডিও দেখতে শুরু করেন। কিছু অ্যাপে নির্দিষ্ট সময় ধরে ভিডিও দেখতে হয়, আবার কিছু অ্যাপে ভিডিওর সাথে সম্পর্কিত ছোটখাটো কাজ (যেমন – লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করা) করতে হতে পারে ।
পয়েন্ট বা কয়েন অর্জন: প্রতিটি ভিডিও দেখার জন্য বা টাস্ক সম্পন্ন করার জন্য ব্যবহারকারীরা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভার্চুয়াল পয়েন্ট, কয়েন বা ইন-অ্যাপ কারেন্সি অর্জন করেন ।
পুরস্কার রিডিম করা: যখন ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পয়েন্ট বা কয়েন জমা হয় (মিনিমাম পে-আউট থ্রেশহোল্ড), তখন তারা সেই পয়েন্ট বা কয়েনগুলো আসল টাকা, মোবাইল রিচার্জ, গিফট কার্ড বা অন্য কোনো পুরস্কারের জন্য রিডিম করতে পারেন ।
জনপ্রিয় ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম করার অ্যাপ
বর্তমানে অনেক অ্যাপ রয়েছে যারা ভিডিও দেখার মাধ্যমে আয়ের সুযোগ দেয়। নিচে এমন কিছু অ্যাপের উদাহরণ এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. গিভি ভিডিওস (Givvy Videos)
গিভি ভিডিওস একটি জনপ্রিয় অ্যাপ যা ব্যবহারকারীদের গান শুনে এবং ভিডিও দেখে প্রকৃত অর্থ উপার্জন করার সুযোগ দেয় ।
কার্যকারিতা: ব্যবহারকারীরা এই অ্যাপে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখতে পারেন এবং গান শুনতে পারেন। যত বেশি সময় ধরে তারা এই কার্যক্রম চালাবেন, তত বেশি ইন-অ্যাপ কয়েন আয় করতে পারবেন ।
আয়ের ধরণ: অর্জিত কয়েনগুলো পরবর্তীতে আসল টাকায় রূপান্তর করা যায়।
পেমেন্ট পদ্ধতি: পেপ্যাল (PayPal), কয়েনবেস (Coinbase), বিনান্স (Binance), অ্যামাজন (Amazon) গিফট কার্ড বা অন্যান্য ভার্চুয়াল ওয়ালেটের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ তোলা যায় । পেমেন্ট সাধারণত দ্রুত প্রক্রিয়া করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ।
বিশেষত্ব: অ্যাপটি দাবি করে যে এটি একটি নির্ভরযোগ্য এবং উচ্চ অর্থ প্রদানকারী অ্যাপ । তবে, এটি গুগল ইনকর্পোরেটেডের সাথে অনুমোদিত নয় ।
২. গিভি শর্টস (Givvy Shorts)
গিভি শর্টস অ্যাপটিও গিভি প্ল্যাটফর্মের একটি অংশ, যেখানে ব্যবহারকারীরা ছোট ছোট ভিডিও (যেমন – রিল, মজার ক্লিপ, বিভিন্ন আগ্রহের ভিডিও) দেখে অর্থ উপার্জন করতে পারেন ।
কার্যকারিতা: ব্যবহারকারীরা সীমাহীন ছোট ভিডিও দেখতে পারেন এবং যত বেশি ভিডিও দেখবেন, তত বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন ।
আয়ের ধরণ: সরাসরি অর্থ উপার্জন, যা বিভিন্ন ভার্চুয়াল ওয়ালেটে তোলা যায়।
পেমেন্ট পদ্ধতি: পেপ্যাল, কয়েনবেস, বিনান্স, অ্যামাজন বা অন্যান্য ভার্চুয়াল ওয়ালেটে সরাসরি টাকা তোলা যায় । পেমেন্ট প্রক্রিয়াকরণের সময় সাধারণত ৭ দিন পর্যন্ত লাগতে পারে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি তাৎক্ষণিক বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায় ।
বিশেষত্ব: অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের জন্য সহজ উপায়ে, এমনকি যাতায়াতের সময় বা অবসর সময়েও অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দেয় ।
৩. ডেইলি আর্ন - ওয়াচ অ্যান্ড আর্ন মানি (Daily Earn - Watch & Earn Money)
এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন গেম খেলা এবং ভিডিও দেখার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করার সুযোগ দেয় ।
কার্যকারিতা: ব্যবহারকারীরা স্পিন হুইল, ডেইলি রিওয়ার্ড, স্ক্র্যাচ কার্ড, টিক ট্যাক টো গেম, সার্ভে এবং ভিডিও ওয়াল (Video Wall) এর মতো বিভিন্ন অপশন ব্যবহার করে কয়েন সংগ্রহ করতে পারেন ।
আয়ের ধরণ: অর্জিত কয়েনগুলো পরবর্তীতে টাকায় রূপান্তর করা যায়।
পেমেন্ট পদ্ধতি: অ্যাপের বিবরণ থেকে পেমেন্ট পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য সবসময় পাওয়া যায় না, তবে সাধারণত এই ধরনের অ্যাপগুলো মোবাইল রিচার্জ বা স্থানীয় পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে থাকে।
বিশেষত্ব: অ্যাপটি দাবি করে যে এটি একটি সহজ এবং ছোট গেমিং অ্যাপ যেখানে চাকা ঘুরিয়ে এবং টাস্ক সম্পন্ন করে অর্থ উপার্জন করা যায় এবং এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায় ।
৪. সোয়াগবাক্স (Swagbucks) ও টোলুনা (Toluna)
এই প্ল্যাটফর্মগুলো মূলত অনলাইন সার্ভের জন্য পরিচিত হলেও, এখানে ভিডিও দেখা, ওয়েব সার্চ করা, গেম খেলা এবং অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমেও পয়েন্ট (SB Points সোয়াগবাক্সের ক্ষেত্রে) অর্জন করার সুযোগ থাকে, যা পরবর্তীতে ক্যাশ বা গিফট কার্ডে রূপান্তর করা যায় ।
কার্যকারিতা: ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট টাস্ক সম্পন্ন করে পয়েন্ট জমাতে থাকেন।
আয়ের ধরণ: পেপ্যাল ক্যাশ বা বিভিন্ন জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের (যেমন – অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট) গিফট কার্ড।
বিশেষত্ব: একটি প্ল্যাটফর্মে একাধিক উপায়ে আয়ের সুযোগ।
৫. অন্যান্য অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্ম
এছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে আরও অনেক অ্যাপ আসে যারা ভিডিও দেখার বিনিময়ে অর্থ বা পুরস্কার দেওয়ার দাবি করে। কিছু ফ্রিল্যান্সিং বা মাইক্রো-টাস্কিং ওয়েবসাইট (যেমন – GigClikers) এও ভিডিও ভিউ, লাইক, কমেন্ট করার মতো ছোট ছোট কাজ পাওয়া যেতে পারে ।
তবে, যেকোনো নতুন অ্যাপ ব্যবহার করার আগে তার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম করার অ্যাপ ব্যবহারের সুবিধা
সহজ কাজ: ভিডিও দেখা তুলনামূলকভাবে একটি সহজ কাজ, এর জন্য বিশেষ কোনো দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।
অবসর সময়ের ব্যবহার: অবসর সময়ে বা যখন হাতে তেমন কোনো কাজ থাকে না, তখন এই অ্যাপগুলো ব্যবহার করে ছোটখাটো আয় করা যেতে পারে।
বিনোদনের সাথে আয়: অনেক সময় পছন্দের ভিডিও বা গান দেখার পাশাপাশি কিছু অর্থও উপার্জন করা যায়।
কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই: বেশিরভাগ অ্যাপ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়।
ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম করার অ্যাপ ব্যবহারের অসুবিধা ও সতর্কতা
ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম করার অ্যাপ ব্যবহারের কিছু নেতিবাচক দিক এবং ঝুঁকির বিষয় রয়েছে, যা সম্পর্কে অবগত থাকা প্রয়োজন:
আয়ের পরিমাণ খুবই কম: সাধারণত এই ধরনের অ্যাপ থেকে আয়ের পরিমাণ খুবই নগণ্য হয়। প্রতি ভিডিও বা প্রতি টাস্কে খুব অল্প পরিমাণ অর্থ বা পয়েন্ট পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় করতে হলে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়।
সময়সাপেক্ষ: মিনিমাম পে-আউট থ্রেশহোল্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। যে পরিমাণ সময় ব্যয় হয়, তার তুলনায় প্রাপ্তি অনেক কম হতে পারে।
প্রতারণামূলক অ্যাপের ঝুঁকি: অনেক অ্যাপ রয়েছে যারা ব্যবহারকারীদের কাজ করিয়ে নেওয়ার পর পেমেন্ট দেয় না অথবা অবাস্তব আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে।
ডেটা খরচ: ভিডিও দেখার জন্য প্রচুর ইন্টারনেট ডেটা খরচ হয়। যদি আয়ের পরিমাণ ডেটা খরচের থেকে কম হয়, তাহলে এটি লাভজনক নাও হতে পারে।
ব্যাটারি খরচ: ক্রমাগত ভিডিও দেখলে মোবাইলের ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যায়।
ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা: কিছু অ্যাপ অপ্রয়োজনীয় পারমিশন চাইতে পারে বা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তার অপব্যবহার করতে পারে।
বিজ্ঞাপনের আধিক্য: অনেক অ্যাপে ভিডিওর চেয়ে বিজ্ঞাপনের পরিমাণ বেশি থাকে, যা ব্যবহারকারীর জন্য বিরক্তিকর হতে পারে।
পেমেন্ট সমস্যা: কিছু অ্যাপে পেমেন্ট পেতে সমস্যা হয় বা নির্দিষ্ট পেমেন্ট পদ্ধতি সমর্থন করে না যা ব্যবহারকারীর জন্য সুবিধাজনক।
কীভাবে সঠিক অ্যাপ নির্বাচন করবেন এবং নিরাপদে ব্যবহার করবেন?
রিভিউ ও রেটিং পরীক্ষা করুন: গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে অ্যাপটির রিভিউ এবং রেটিং ভালোভাবে দেখুন। অন্য ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানুন।
ডাউনলোড সংখ্যা দেখুন: যে অ্যাপ বেশি সংখ্যকবার ডাউনলোড হয়েছে, সেটি তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য হতে পারে।
পেমেন্ট প্রুফ (Payment Proof) খুঁজুন: ইউটিউব বা বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে দেখুন কেউ সেই অ্যাপ থেকে পেমেন্ট পেয়েছে কিনা।
শর্তাবলী ও গোপনীয়তা নীতি পড়ুন: অ্যাপের ব্যবহারের শর্তাবলী এবং গোপনীয়তা নীতি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।
অবাস্তব প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে চলুন: যে অ্যাপ রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখায়, সেটি থেকে দূরে থাকুন।
অজানা উৎস থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করবেন না: শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য অ্যাপ স্টোর থেকেই অ্যাপ ডাউনলোড করুন।
ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন: খুব বেশি ব্যক্তিগত বা আর্থিক তথ্য চায় এমন অ্যাপ ব্যবহার করার আগে ভালোভাবে চিন্তা করুন।
শেষ কথা
ভিডিও দেখে টাকা ইনকাম করার অ্যাপগুলো অবসর সময়ে ছোটখাটো পকেটমানি আয়ের একটি উপায় হতে পারে, তবে এটিকে নিয়মিত বা বড় অঙ্কের আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়।
এই ধরনের অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরতে হবে এবং আয়ের পরিমাণ নিয়ে বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা রাখতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যেকোনো অ্যাপ ব্যবহার করার আগে তার বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া এবং ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা।
যদি সঠিকভাবে এবং বিচক্ষণতার সাথে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এই অ্যাপগুলো আপনার অবসর সময়কে কিছুটা হলেও ফলপ্রসূ করে তুলতে পারে।


إرسال تعليق