শেয়ার বাজার, স্টক মার্কেট বা পুঁজিবাজার – এই নামগুলো শুনলেই সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের কৌতূহল এবং কিছুটা রহস্যময়তার সৃষ্টি হয়। খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে প্রায়শই আমরা শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়া-কমার খবর দেখতে পাই।
অনেকের কাছেই এটি একটি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা বলে মনে হয়, যেখানে শুধুমাত্র বড় বড় ব্যবসায়ী বা আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বিচরণ করেন। আবার, কেউ কেউ এটিকে দ্রুত ধনী হওয়ার একটি মাধ্যম হিসেবেও কল্পনা করেন।বাস্তবতা হলো, শেয়ার বাজার একটি সুসংগঠিত এবং আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক বাজার, যেখানে যে কেউ (কিছু শর্ত সাপেক্ষে) বিনিয়োগ করতে পারে।
সঠিক জ্ঞান, পরিকল্পনা এবং ধৈর্য থাকলে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদে ভালো মুনাফা অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। তবে, না জেনে বা গুজবের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করলে এখানে ক্ষতির সম্ভাবনাও প্রবল।
এই আর্টিকেলে আমরা শেয়ার বাজার কী, এটি কীভাবে কাজ করে, শেয়ার কাকে বলে, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য অপরিহার্য বিও অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়া এবং নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু প্রাথমিক বিষয় অত্যন্ত সহজ ভাষায় আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আমাদের লক্ষ্য হলো, শেয়ার বাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনের দ্বিধা ও ভয় দূর করে একটি স্বচ্ছ এবং মৌলিক ধারণা প্রদান করা, যাতে তারা এই বিষয়ে জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
শেয়ার বাজার কাকে বলে? একটি সহজ ব্যাখ্যা
শেয়ার বাজার বা স্টক মার্কেট সম্পর্কে জানার আগে আমাদের "শেয়ার" এবং "বাজার" এই দুটি শব্দকে আলাদাভাবে বুঝতে হবে।
শেয়ার কী?
"শেয়ার" (Share) একটি ইংরেজি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হলো অংশ বা ভাগ। ব্যবসার পরিভাষায়, শেয়ার হলো কোনো কোম্পানির মোট মালিকানার একটি ক্ষুদ্রতম অংশ বা ইউনিট । যখন একটি কোম্পানি (বিশেষ করে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি) তার ব্যবসার সম্প্রসারণ বা অন্য কোনো প্রয়োজনে অতিরিক্ত মূলধন সংগ্রহ করতে চায়, তখন তারা তাদের কোম্পানির মোট মালিকানাকে অসংখ্য ছোট ছোট সমান অংশে ভাগ করে। এই প্রতিটি অংশকেই এক একটি শেয়ার বা স্টক বলা হয় ।
উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি কোম্পানির মোট মূলধন ১ কোটি টাকা হয় এবং তারা যদি প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যের ১০ লক্ষ শেয়ারে তাদের মালিকানা ভাগ করে, তবে প্রতিটি ১০ টাকার অংশ হলো একটি শেয়ার। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই শেয়ার কেনে, সে ওই কোম্পানির আনুপাতিক মালিকানার অংশীদার হয়।
অর্থাৎ, আপনি যদি কোনো কোম্পানির ১০০টি শেয়ার কেনেন, তাহলে আপনি ওই কোম্পানির একজন ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডার বা অংশীদার।
শেয়ার কেনার মাধ্যমে একজন সাধারণ বিনিয়োগকারীও দেশের বড় বড় এবং স্বনামধন্য কোম্পানিগুলোর মালিকানার অংশীদার হতে পারে। এর ফলে, সেই কোম্পানি যদি লাভ করে, তবে শেয়ারহোল্ডাররাও বিভিন্নভাবে (যেমন - লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড এবং শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি) সেই লাভের অংশ পেতে পারে।
শেয়ার বাজার কী?
"বাজার" বলতে আমরা সাধারণত এমন একটি স্থানকে বুঝি যেখানে বিভিন্ন পণ্য বা সেবা কেনা-বেচা হয়। একইভাবে, শেয়ার বাজার বা স্টক মার্কেট (Stock Market) হলো এমন একটি সুসংগঠিত এবং নিয়ন্ত্রিত স্থান বা প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার (এবং অন্যান্য সিকিউরিটিজ যেমন বন্ড, ডিবেঞ্চার, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট) নিয়মিতভাবে কেনা-বেচা বা লেনদেন করা হয় ।
এই বাজারটি কোম্পানিগুলোর জন্য তাদের প্রয়োজনীয় মূলধন বা পুঁজি সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে । কোম্পানিগুলো তাদের শেয়ার বাজারে বিক্রি করে সাধারণ মানুষ বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এবং সেই অর্থ তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা, নতুন প্রকল্প গ্রহণ বা ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজে লাগায়। একারণে শেয়ার বাজারকে "পুঁজিবাজার" (Capital Market) নামেও অভিহিত করা হয় ।
অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের জন্য শেয়ার বাজার হলো তাদের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করে আয় বৃদ্ধি করার একটি অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। তারা বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনে সেই কোম্পানির ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির অংশীদার হওয়ার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে প্রধান দুটি শেয়ার বাজার বা স্টক এক্সচেঞ্জ রয়েছে:
- ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (Dhaka Stock Exchange - DSE)
- চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (Chittagong Stock Exchange -
CSE)
এই স্টক এক্সচেঞ্জগুলো শেয়ার এবং অন্যান্য সিকিউরিটিজ লেনদেনের জন্য একটি স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ নিশ্চিত করে। পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশেই নিজস্ব শেয়ার বাজার রয়েছে, যেমন - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ (NYSE), নাসডাক (NASDAQ); ভারতের বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ (BSE), ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (NSE); জাপানের টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (TSE) ইত্যাদি ।
শেয়ার বাজার একটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বিনিয়োগ উৎসাহিত করে, মূলধন গঠনে সহায়তা করে, কোম্পানিগুলোকে তাদের ব্যবসার প্রসারে সাহায্য করে এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। একটি দেশের শেয়ার বাজারের অবস্থা বা সূচক প্রায়শই সেই দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে বিবেচিত হয় ।
বিশ্লেষণ:
শেয়ার বাজার মূলত কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপনকারী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসার প্রসারের জন্য যখন অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন অনুভব করে, তখন তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিবর্তে বা ঋণের পাশাপাশি শেয়ার বাজারে আসে।
শেয়ার ইস্যু করার মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষ বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানির মালিকানার একটি অংশ বিক্রি করে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করে ।
এর সুবিধা হলো, ঋণের মতো নির্দিষ্ট সময় পর পর সুদ পরিশোধের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না (যদিও কোম্পানি লাভ করলে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়ার একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়)।
অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন কারণে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- মূলধন বৃদ্ধি (Capital Appreciation): যদি কোনো কোম্পানির ব্যবসায়িক পারফরম্যান্স ভালো হয় এবং তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল থাকে, তাহলে বাজারে সেই কোম্পানির শেয়ারের চাহিদা বাড়ে এবং এর ফলে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগকারীরা কম দামে শেয়ার কিনে বেশি দামে বিক্রি করে এই মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা নিতে পারে।
- লভ্যাংশ আয় (Dividend Income): অনেক কোম্পানি তাদের অর্জিত মুনাফার একটি অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড হিসেবে বিতরণ করে । এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিয়মিত আয়ের উৎস হতে পারে।
- মালিকানার অনুভূতি: কোনো স্বনামধন্য কোম্পানির শেয়ার ধারণ করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা সেই কোম্পানির মালিকানার অংশীদার হওয়ার একটি মানসিক তৃপ্তিও লাভ করে।
শেয়ার বাজারে কোনো নির্দিষ্ট শেয়ারের দাম মূলত সেই শেয়ারের চাহিদা (demand) এবং সরবরাহ (supply) এর উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। যদি কোনো শেয়ারের চাহিদা তার সরবরাহের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে তার দাম বাড়ে। বিপরীতভাবে, যদি সরবরাহ চাহিদার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে দাম কমে।
এই চাহিদা ও সরবরাহ আবার বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, যেমন - কোম্পানির আর্থিক ফলাফল ও পারফরম্যান্স, কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা, সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও মনোভাব, এবং এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব।
একটি দেশের শেয়ার বাজারের সামগ্রিক অবস্থা বা গতিবিধি প্রায়শই সেই দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক বা ব্যারোমিটার হিসেবে কাজ করে । যখন শেয়ার বাজার তেজি থাকে (অর্থাৎ বেশিরভাগ শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে), তখন এটি সাধারণত নির্দেশ করে যে দেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে, কোম্পানিগুলো ভালো ব্যবসা করছে এবং বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আস্থাশীল।
বিপরীতভাবে, শেয়ার বাজারের মন্দা (অর্থাৎ বেশিরভাগ শেয়ারের দাম কমতে থাকা) প্রায়শই অর্থনৈতিক দুর্বলতা বা অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয়। একটি সক্রিয়, স্বচ্ছ এবং ক্রমবর্ধমান শেয়ার বাজার দেশীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে, যা দেশের শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তবে, শেয়ার বাজারে যদি অতিরিক্ত ফটকাবাজি (speculation), কারসাজি (manipulation) বা অনিয়ম ঘটে, তাহলে তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে এবং এটি সামগ্রিক অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একারণেই শেয়ার বাজারের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং কঠোর নিয়ম-কানুনের প্রয়োজন হয়।
শেয়ার বাজারের কার্যপ্রণালী এবং এর উপাদানসমূহ
শেয়ার বাজার একটি জটিল ব্যবস্থা যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অংশগ্রহণকারী এবং প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত। এর কার্যপ্রণালী সুষ্ঠুভাবে বোঝার জন্য এর প্রধান উপাদানগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
- স্টক এক্সচেঞ্জ (Stock Exchange): এটি হলো শেয়ার বাজারের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (DSE) বা চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (CSE) হলো এমন নিবন্ধিত এবং নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান যেখানে তালিকাভুক্ত (listed) পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিগুলোর শেয়ার এবং অন্যান্য সিকিউরিটিজ (যেমন বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড) কেনা-বেচার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করা হয় ।
স্টক এক্সচেঞ্জ লেনদেনের নিয়মকানুন নির্ধারণ করে, স্বচ্ছতা বজায় রাখে এবং বাজারের তথ্যাদি (যেমন শেয়ারের দাম, লেনদেনের পরিমাণ) প্রকাশ করে। এটি রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে (যেমন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২:৩০ পর্যন্ত) লেনদেনের জন্য খোলা থাকে । - ব্রোকারেজ হাউজ/স্টক ব্রোকার (Brokerage House/Stock Broker): সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সরাসরি স্টক এক্সচেঞ্জে গিয়ে শেয়ার কেনা-বেচা করতে পারে না। তাদের অবশ্যই স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য কোনো ব্রোকারেজ হাউজ বা স্টক ব্রোকারের মাধ্যমে লেনদেন করতে হয় ।
ব্রোকারেজ হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে শেয়ার কেনা-বেচার আদেশ স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং সিস্টেমে প্রেরণ করে এবং লেনদেন সম্পন্ন হলে তা বিনিয়োগকারীকে জানিয়ে দেয়। এই সেবার বিনিময়ে ব্রোকারেজ হাউজগুলো একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন বা ফি নিয়ে থাকে। - বিও (Beneficiary Owner's) অ্যাকাউন্ট: শেয়ার বাজারে লেনদেন করার জন্য প্রতিটি বিনিয়োগকারীকে কোনো একটি ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় । এই অ্যাকাউন্টটি অনেকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতোই, তবে এখানে টাকা জমার পরিবর্তে শেয়ার এবং অন্যান্য সিকিউরিটিজ ইলেকট্রনিক ফর্মে জমা থাকে।
যখন কোনো বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনে, তখন সেই শেয়ার তার বিও অ্যাকাউন্টে জমা হয়, এবং যখন বিক্রি করে, তখন তার অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার কমে যায় এবং বিক্রিত অর্থ তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (অথবা ব্রোকারেজ হাউজের সাথে লিংক করা অ্যাকাউন্টে) জমা হয়।
বর্তমানে অনেক ব্রোকারেজ হাউজ অনলাইনে বিও অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা প্রদান করছে । বিও অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য সাধারণত জাতীয় পরিচয়পত্র (NID), পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ এবং নমিনির তথ্য প্রয়োজন হয় । - সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (Central Depository Bangladesh
Limited - CDBL): এটি এমন একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা যেখানে বিনিয়োগকারীদের সকল শেয়ার এবং অন্যান্য সিকিউরিটিজ ডিম্যাটেরিয়ালাইজড বা ইলেকট্রনিক ফর্মে (dematerialized form) সংরক্ষিত থাকে।
এর ফলে শেয়ার সার্টিফিকেট হারিয়ে যাওয়া, চুরি হওয়া বা জাল হওয়ার কোনো ভয় থাকে না এবং লেনদেন প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত ও সহজ হয়। ব্রোকারেজ হাউজগুলো CDBL এর সাথে সংযুক্ত থেকে বিনিয়োগকারীদের বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার আদান-প্রদান সম্পন্ন করে। - বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (Bangladesh Securities and
Exchange Commission - BSEC): এটি হলো বাংলাদেশের শেয়ার বাজার এবং অন্যান্য পুঁজি বাজারের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা। BSEC এর মূল কাজ হলো বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা, বাজারের স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নতুন সিকিউরিটিজ ইস্যু করার অনুমোদন দেওয়া, স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কার্যক্রম তদারকি করা এবং পুঁজিবাজার সংক্রান্ত আইনকানুন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা।
- তালিকাভুক্ত কোম্পানি (Listed Companies): যেসকল পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জের নির্ধারিত শর্তাবলি পূরণ করে তাদের শেয়ার জনসাধারণের মধ্যে কেনা-বেচার জন্য স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত হয়, তাদের তালিকাভুক্ত কোম্পানি বলে। শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারই স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন করা যায়।
- বিনিয়োগকারী (Investors): ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যারা মুনাফা অর্জনের আশায় শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়োগ করে, তাদের বিনিয়োগকারী বলা হয়। বিনিয়োগকারীরা সাধারণত দুই ধরনের হয় - ক্ষুদ্র বা রিটেইল বিনিয়োগকারী (Retail Investors) এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী (Institutional Investors, যেমন - ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড)।
এই উপাদানগুলো একে অপরের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করে একটি কার্যকরী এবং গতিশীল শেয়ার বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা লেনদেনের নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
শেয়ারের প্রকারভেদ: প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট
শেয়ার বাজারে লেনদেন মূলত দুটি প্রধান পর্যায়ে বা মার্কেটে বিভক্ত: প্রাইমারি মার্কেট এবং সেকেন্ডারি মার্কেট। নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য এই দুটি মার্কেটের পার্থক্য এবং কার্যপ্রণালী বোঝা অত্যন্ত জরুরি।
প্রাইমারি মার্কেট (আইপিও মার্কেট):
প্রাইমারি মার্কেট হলো সেই বাজার যেখানে কোনো কোম্পানি প্রথমবারের মতো জনসাধারণের কাছে তাদের শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংগ্রহ করে । এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং বা আইপিও (Initial Public Offering - IPO)।
যখন একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়ে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে চায়, অথবা কোনো বিদ্যমান পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নতুন করে আরও শেয়ার ইস্যু করে অতিরিক্ত মূলধন তুলতে চায়, তখন তারা আইপিও বা ক্ষেত্রবিশেষে রাইট অফার (Right Offer) বা রিপিট পাবলিক অফার (Repeat Public
Offer - RPO) এর মাধ্যমে প্রাইমারি মার্কেটে শেয়ার অফার করে।
প্রাইমারি মার্কেটে কোম্পানি সরাসরি বিনিয়োগকারীদের কাছে (সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অফার মূল্যে) শেয়ার বিক্রি করে এবং প্রাপ্ত অর্থ কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রমে (যেমন - নতুন কারখানা স্থাপন, ঋণ পরিশোধ, গবেষণা ও উন্নয়ন) ব্যবহৃত হয়।
এই মার্কেটে শেয়ারের দাম সাধারণত কোম্পানি, ইস্যু ম্যানেজার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার (যেমন BSEC) অনুমোদনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এই নির্ধারিত মূল্যের মধ্যে থাকতে পারে শেয়ারের অভিহিত মূল্য (Face Value) এবং ক্ষেত্রবিশেষে একটি প্রিমিয়াম (Premium) ।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে প্রাইমারি মার্কেটে বা আইপিওতে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম থাকে এবং লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে ।
এর একটি কারণ হলো, আইপিওতে শেয়ার একটি নির্দিষ্ট মূল্যে অফার করা হয় এবং প্রায়শই দেখা যায় যে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির পর সেকেন্ডারি মার্কেটে সেই শেয়ারের দাম অফার মূল্যের চেয়ে বেড়ে যায়।
তবে, এটি সবসময় সত্য নাও হতে পারে; কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্তির পর দাম কমেও যেতে পারে। আইপিওতে শেয়ার পাওয়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের আবেদন করতে হয় এবং সাধারণত লটারির মাধ্যমে বা আনুপাতিক হারে শেয়ার বরাদ্দ করা হয়।
প্রাইমারি মার্কেটের মূল গুরুত্ব হলো এটি নতুন এবং সম্ভাবনাময় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে প্রবেশ করতে এবং তাদের ব্যবসার প্রসারের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করতে সাহায্য করে। এটি দেশের শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সেকেন্ডারি মার্কেট:
সেকেন্ডারি মার্কেট হলো সেই বাজার যেখানে প্রাইমারি মার্কেটে ইস্যু করা শেয়ারগুলো (অর্থাৎ, আইপিওতে বরাদ্দ পাওয়ার পর) বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত কেনা-বেচা বা লেনদেন হয় । আমরা যখন সাধারণভাবে "শেয়ার বাজারে শেয়ার কেনা-বেচা" করার কথা বলি, তখন মূলত সেকেন্ডারি মার্কেটকেই বোঝানো হয়। স্টক এক্সচেঞ্জ (যেমন DSE, CSE) হলো সেকেন্ডারি মার্কেটের প্রধান প্ল্যাটফর্ম।
সেকেন্ডারি মার্কেটে কোনো কোম্পানি সরাসরি জড়িত থাকে না; এখানে লেনদেন হয় একজন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে অন্য বিনিয়োগকারীর কাছে। এই মার্কেটে শেয়ারের দাম কোনো নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত মূল্যে স্থির থাকে না, বরং এটি প্রতি মুহূর্তে চাহিদা ও সরবরাহের (demand and supply) ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়।
যদি কোনো শেয়ারের ক্রেতার সংখ্যা বিক্রেতার সংখ্যার চেয়ে বেশি হয় (অর্থাৎ চাহিদা বেশি), তাহলে তার দাম বাড়ে। বিপরীতভাবে, যদি বিক্রেতার সংখ্যা ক্রেতার সংখ্যার চেয়ে বেশি হয় (অর্থাৎ সরবরাহ বেশি), তাহলে তার দাম কমে।
এই চাহিদা ও সরবরাহ আবার অসংখ্য বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, যেমন - কোম্পানির পারফরম্যান্স, মুনাফা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, লভ্যাংশ ঘোষণার হার, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগকারীদের সেন্টিমেন্ট ইত্যাদি।
সেকেন্ডারি মার্কেটে লাভের সম্ভাবনা যেমন অনেক বেশি থাকে, তেমনি লোকসানের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি থাকে । কারণ, শেয়ারের দাম যেকোনো সময় অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়তে বা কমতে পারে। এই মার্কেটে সফলভাবে বিনিয়োগ করার জন্য বাজার সম্পর্কে ভালো জ্ঞান, কোম্পানি বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কৌশল জানা অপরিহার্য ।
সেকেন্ডারি মার্কেটের প্রধান গুরুত্ব হলো এটি শেয়ার এবং অন্যান্য সিকিউরিটিজের জন্য তারল্য (liquidity) নিশ্চিত করে। তারল্য মানে হলো, বিনিয়োগকারীরা তাদের হাতে থাকা শেয়ার সহজেই নগদ অর্থে রূপান্তর করতে পারে, কারণ এখানে সবসময় ক্রেতা ও বিক্রেতা উপস্থিত থাকে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। এই তারল্যের কারণেই বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়।
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের প্রাথমিক ধাপসমূহ
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, তবে না জেনে বা সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া এই পথে নামলে লাভের চেয়ে লোকসানের সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু প্রাথমিক ধাপ অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি, যা তাদের একটি সুশৃঙ্খল এবং তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বিনিয়োগ যাত্রা শুরু করতে সাহায্য করবে।
- শেয়ার বাজার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা: বিনিয়োগ শুরু করার আগে শেয়ার বাজার কীভাবে কাজ করে, বিভিন্ন ধরনের সিকিউরিটিজ (শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড) কী, বাজারের বিভিন্ন পরিভাষা (যেমন ইপিএস, পি/ই রেশিও, ডিভিডেন্ড), বাজার বিশ্লেষণের পদ্ধতি (মৌলভিত্তি ও কারিগরি বিশ্লেষণ) ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য ।
এর জন্য আপনি অনলাইন কোর্স করতে পারেন, শেয়ার বাজার সম্পর্কিত বই বা আর্টিকেল পড়তে পারেন, অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের ব্লগ বা ভিডিও দেখতে পারেন, অথবা বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আয়োজিত সেমিনার বা ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করতে পারেন। জ্ঞানই আপনার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। - নিজের আর্থিক লক্ষ্য এবং ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা নির্ধারণ করা: আপনি কেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে চান (যেমন - দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ তৈরি, সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগানো, অবসরকালীন পরিকল্পনা) এবং কতটুকু ঝুঁকি আপনি নিতে পারবেন, তা শুরুতেই নির্ধারণ করা উচিত।
আপনার বয়স, আয়, সঞ্চয়, ঋণ এবং পারিবারিক দায়বদ্ধতার উপর ভিত্তি করে আপনার ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা পরিবর্তিত হতে পারে। উচ্চ ঝুঁকি নিলে উচ্চ লাভের সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু লোকসানের আশঙ্কাও বেশি থাকে। - একটি ভালো ব্রোকারেজ হাউজ নির্বাচন করা এবং বিও অ্যাকাউন্ট খোলা: বাংলাদেশে শেয়ার কেনা-বেচা করার জন্য আপনাকে অবশ্যই কোনো একটি নিবন্ধিত ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে একটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে । ব্রোকারেজ হাউজ নির্বাচন করার সময় তাদের সেবার মান, কমিশন রেট, অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মের সুবিধা, গবেষণামূলক সহায়তা এবং গ্রাহক সেবার মান বিবেচনা করুন। বিও অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য সাধারণত আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ এবং নমিনির তথ্যাদি প্রয়োজন হবে । অনেক ব্রোকারেজ হাউজ এখন অনলাইনেও বিও অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা দিচ্ছে।
- কোম্পানির মৌলভিত্তি (Fundamental Analysis) এবং শেয়ারের মূল্য তালিকা (Technical Analysis) বিশ্লেষণ করতে শেখা: কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনার আগে সেই কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত। মৌলভিত্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্য, ব্যবসার ধরণ, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ইত্যাদি মূল্যায়ন করা হয় ।
অন্যদিকে, কারিগরি বিশ্লেষণের মাধ্যমে শেয়ারের অতীতের মূল্য এবং লেনদেনের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতিবিধি অনুমান করার চেষ্টা করা হয় । নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য অন্তত মৌলভিত্তি বিশ্লেষণের প্রাথমিক বিষয়গুলো শিখে নেওয়া ভালো। - শুরুতে অল্প পরিমাণ অর্থ দিয়ে বিনিয়োগ শুরু করা: প্রথমবারেই বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে শেয়ার বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রথমে অল্প পরিমাণ অর্থ (যা হারালেও আপনার আর্থিক জীবনে বড় প্রভাব ফেলবে না) দিয়ে বিনিয়োগ শুরু করুন । এর মাধ্যমে আপনি বাজারের গতিবিধি বুঝতে পারবেন, নিজের ভুল থেকে শিখতে পারবেন এবং ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন।
- ধৈর্য ধারণ করা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রাখা: শেয়ার বাজার কোনো দ্রুত টাকা বানানোর মেশিন নয়। এখানে সফল হতে হলে ধৈর্য ধরতে হবে এবং একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা অনুসরণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদী উত্থান-পতনে আতঙ্কিত না হয়ে ভালো কোম্পানির শেয়ারে দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ ধরে রাখলে ভালো রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
- গুজবে কান না দিয়ে নিজের বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করা: শেয়ার বাজারে প্রায়শই বিভিন্ন ধরনের গুজব বা টিপস ছড়ায়। অন্যের কথা শুনে বা গুজবের উপর ভিত্তি করে কোনো শেয়ার কেনা-বেচা করা থেকে বিরত থাকুন। নিজের গবেষণা এবং বিশ্লেষণের উপর আস্থা রাখুন।
- পোর্টফোলিও ডাইভারসিফাই করা: আপনার সমস্ত বিনিয়োগ একটি মাত্র শেয়ারে বা একটি মাত্র খাতে না রেখে বিভিন্ন ভালো কোম্পানির শেয়ারে এবং বিভিন্ন খাতে ভাগ করে বিনিয়োগ করুন। এটি আপনার বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
এই ধাপগুলো নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করলে নতুন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বাজারে একটি সুশৃঙ্খল এবং আত্মবিশ্বাসী পদার্পণ করতে পারবে এবং বড় ধরনের লোকসানের ঝুঁকি অনেকাংশে এড়াতে পারবে।
শেয়ার বাজার সর্ম্পকিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিভাষা (সংক্ষেপে)
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে হলে এর সাথে সম্পর্কিত কিছু মৌলিক পরিভাষা সম্পর্কে ধারণা থাকা অপরিহার্য। এই পরিভাষাগুলো বুঝতে পারলে বাজার বিশ্লেষণ করা এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলো:
- ইপিএস (Earnings Per Share) বা শেয়ার প্রতি আয়: কোনো কোম্পানি একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছরে) তার মোট শেয়ারের বিপরীতে যে পরিমাণ মুনাফা অর্জন করে, তাকে শেয়ার প্রতি আয় বা ইপিএস বলে।
এটি গণনা করা হয় কোম্পানির মোট কর পরবর্তী নিট মুনাফাকে তার মোট সাধারণ শেয়ারের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে। ইপিএস যত বেশি হয়, সাধারণত সেই কোম্পানির আর্থিক অবস্থা তত ভালো এবং তার শেয়ার তত বেশি আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয় । - পি/ই রেশিও (Price to Earnings Ratio) বা মূল্য-আয় অনুপাত: এটি একটি জনপ্রিয় মূল্যায়ন মেট্রিক যা কোনো শেয়ারের বর্তমান বাজার মূল্যকে তার শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দিয়ে ভাগ করে গণনা করা হয় । অর্থাৎ, পি/ই রেশিও = শেয়ারের বর্তমান বাজার মূল্য / ইপিএস।
এই অনুপাতটি নির্দেশ করে যে বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানির প্রতি ১ টাকা আয়ের জন্য কত টাকা মূল্য দিতে ইচ্ছুক। সাধারণত, কম পি/ই রেশিও সম্পন্ন শেয়ারকে অবমূল্যায়িত (undervalued) এবং বেশি পি/ই রেশিও সম্পন্ন শেয়ারকে অতিমূল্যায়িত (overvalued) বলে মনে করা হয়। তবে, এটি শিল্প খাত এবং কোম্পানির প্রবৃদ্ধির হারের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন হতে পারে। - ডিভিডেন্ড (Dividend) বা লভ্যাংশ: কোম্পানি তার অর্জিত মুনাফার যে অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করে, তাকে ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ বলা হয় । ডিভিডেন্ড সাধারণত দুই ধরনের হয়:
- ক্যাশ ডিভিডেন্ড (Cash Dividend): যখন কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান করে।
- স্টক ডিভিডেন্ড (Stock Dividend) বা বোনাস শেয়ার (Bonus Share): যখন কোম্পানি নগদ অর্থের পরিবর্তে শেয়ারহোল্ডারদের অতিরিক্ত নতুন শেয়ার প্রদান করে।
- ফেস ভ্যালু (Face Value) বা অভিহিত মূল্য: এটি হলো শেয়ারের প্রাথমিক বা দাপ্তরিক মূল্য যা কোম্পানির সংঘস্মারক বা শেয়ার সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা থাকে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের ফেস ভ্যালু ১০ টাকা।
- মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন (Market Capitalization) বা বাজার মূলধন: কোনো কোম্পানির মোট শেয়ারের সংখ্যাকে তার প্রতিটি শেয়ারের বর্তমান বাজার মূল্য দিয়ে গুণ করলে যা পাওয়া যায়, তাই হলো ওই কোম্পানির মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন।
এটি কোম্পানির আকার বা মোট বাজার মূল্য নির্দেশ করে। মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের ভিত্তিতে কোম্পানিগুলোকে সাধারণত লার্জ-ক্যাপ, মিড-ক্যাপ এবং স্মল-ক্যাপ এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। - আইপিও (Initial Public Offering) বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব: যখন কোনো কোম্পানি প্রথমবারের মতো জনসাধারণের কাছে শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংগ্রহ করে, তখন তাকে আইপিও বলে ।
- বিও (Beneficiary Owner's) অ্যাকাউন্ট: শেয়ার বাজারে লেনদেন করার জন্য বিনিয়োগকারীদের যে বিশেষ ধরনের ইলেকট্রনিক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়, তাকে বিও অ্যাকাউন্ট বলে ।
- ব্রোকার (Broker) বা দلال: যে অনুমোদিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ার কেনা-বেচার আদেশ কার্যকর করে, তাকে ব্রোকার বলে ।
- বুল মার্কেট (Bull Market) বা তেজি বাজার: যখন শেয়ার বাজারের সূচক এবং বেশিরভাগ শেয়ারের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তখন সেই অবস্থাকে বুল মার্কেট বা তেজি বাজার বলে।
- বেয়ার মার্কেট (Bear Market) বা মন্দা বাজার: যখন শেয়ার বাজারের সূচক এবং বেশিরভাগ শেয়ারের দাম ক্রমাগত কমতে থাকে, তখন সেই অবস্থাকে বেয়ার মার্কেট বা মন্দা বাজার বলে।
- পোর্টফোলিও (Portfolio): একজন বিনিয়োগকারীর মালিকানায় থাকা বিভিন্ন ধরনের সিকিউরিটিজ (যেমন - বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড) এর সমষ্টিকে তার পোর্টফোলিও বলে।
এই পরিভাষাগুলো শেয়ার বাজারের খবরাখবর, কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন এবং বাজার বিশ্লেষণ বোঝার জন্য খুবই সহায়ক।
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও লাভের সম্ভাবনা
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ যেমন আকর্ষণীয় লাভের সুযোগ নিয়ে আসে, তেমনই এর সাথে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিও জড়িত থাকে। বিনিয়োগ করার আগে এই লাভ এবং ঝুঁকি উভয় দিক সম্পর্কেই একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা অপরিহার্য।
লাভের সম্ভাবনা:
- মূলধন বৃদ্ধি (Capital Appreciation): এটি শেয়ার বাজার থেকে লাভের অন্যতম প্রধান উপায়। যখন আপনি কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনেন এবং পরবর্তীতে সেই শেয়ারের বাজার মূল্য বেড়ে যায়, তখন আপনি শেয়ারটি বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করতে পারেন। যদি একটি কোম্পানি ভালো ব্যবসা করে, তার মুনাফা বাড়ে এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়, তাহলে সাধারণত বাজারে তার শেয়ারের চাহিদা বাড়ে এবং দামও বৃদ্ধি পায়।
- ডিভিডেন্ড আয় (Dividend Income): অনেক কোম্পানি তাদের অর্জিত মুনাফার একটি অংশ নিয়মিতভাবে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড হিসেবে বিতরণ করে । এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অতিরিক্ত আয়ের উৎস হতে পারে, বিশেষ করে যারা দীর্ঘমেয়াদে শেয়ার ধরে রাখেন। ডিভিডেন্ড সাধারণত নগদ অর্থে (Cash Dividend) বা অতিরিক্ত শেয়ার (Stock Dividend/Bonus Share) আকারে দেওয়া হয়।
- দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতিকে হারানোর সম্ভাবনা: ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে যে, দীর্ঘমেয়াদে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত গড় রিটার্ন মুদ্রাস্ফীতির হারকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। এর মানে হলো, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ আপনার টাকার ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখতে বা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে, যা ব্যাংক সঞ্চয় বা অন্যান্য কম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবসময় সম্ভব হয় না।
- মালিকানার অংশীদারিত্ব: শেয়ার কেনার মাধ্যমে আপনি একটি কোম্পানির মালিকানার অংশীদার হন। এর ফলে, আপনি কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (AGM) অংশগ্রহণ করতে, ভোট দিতে এবং কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে (পরোক্ষভাবে) ভূমিকা রাখতে পারেন।
- তারল্য (Liquidity): শেয়ার বাজারের একটি বড় সুবিধা হলো এর তারল্য। অর্থাৎ, আপনি আপনার হাতে থাকা শেয়ার (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) সহজেই বিক্রি করে নগদ অর্থে রূপান্তর করতে পারেন, যখন আপনার অর্থের প্রয়োজন হয়।
ঝুঁকি:
- বাজার ঝুঁকি (Market Risk): এটি এমন ঝুঁকি যা পুরো শেয়ার বাজার বা একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করে। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সুদের হারের পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বৈশ্বিক কোনো ঘটনার কারণে সামগ্রিক বাজার পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে এবং এর ফলে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দামও কমে যেতে পারে। এই ঝুঁকি কোনো একক কোম্পানির পারফরম্যান্সের উপর নির্ভরশীল নয়।
- কোম্পানি ঝুঁকি (Company-Specific Risk) বা ব্যবসায়িক ঝুঁকি: এটি কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির দুর্বল পারফরম্যান্স, ভুল ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত, ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা, নতুন প্রতিযোগীর আগমন, আইনি সমস্যা বা কোনো নেতিবাচক খবরের কারণে সেই কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যাওয়ার ঝুঁকি। এই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য বিনিয়োগের আগে কোম্পানি সম্পর্কে ভালোভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন।
- তারল্য ঝুঁকি (Liquidity Risk): কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ার (বিশেষ করে ছোট বা দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি, যেমন 'Z' ক্যাটাগরির শেয়ার ) বাজারে সহজে কেনা-বেচা করা না-ও যেতে পারে। অর্থাৎ, আপনি যখন শেয়ারটি বিক্রি করতে চাইবেন, তখন হয়তো পর্যাপ্ত ক্রেতা পাবেন না, অথবা আপনাকে অনেক কম দামে বিক্রি করতে হতে পারে।
- সুদের হারের ঝুঁকি (Interest Rate Risk): যখন দেশে সুদের হার বাড়ে, তখন অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে ব্যাংক বা বন্ডের মতো স্থির আয়ের খাতে বিনিয়োগ করতে পারে, যার ফলে শেয়ার বাজারে শেয়ারের চাহিদা কমে দাম কমতে পারে।
- মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি (Inflation Risk): উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি কোম্পানির উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং মুনাফা কমিয়ে দিতে পারে, যা শেয়ারের দামের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকি (Currency Risk): যারা বিদেশী শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, তাদের জন্য মুদ্রা বিনিময় হারের পরিবর্তনের কারণেও লোকসান হতে পারে।
- অজ্ঞতা বা ভুল সিদ্ধান্তের ঝুঁকি: শেয়ার বাজার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকলে বা গুজবের উপর ভিত্তি করে ভুল শেয়ার নির্বাচন করলে বা ভুল সময়ে কেনা-বেচা করলে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে।
শেয়ার বাজারে "উচ্চ ঝুঁকি, উচ্চ লাভ" – এই নীতিটি প্রায়শই প্রযোজ্য হয় । তবে, কিছু কৌশল অবলম্বন করে এই ঝুঁকিগুলো কমানো বা ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। যেমন:
- পোর্টফোলিও ডাইভারসিফিকেশন: আপনার সমস্ত বিনিয়োগ একটি মাত্র শেয়ারে বা একটি মাত্র খাতে না রেখে বিভিন্ন ভালো কোম্পানির শেয়ারে এবং বিভিন্ন খাতে (যেমন - ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যালস, জ্বালানি, টেলিকম) ভাগ করে বিনিয়োগ করুন। এর ফলে, কোনো একটি শেয়ার বা খাতের পারফরম্যান্স খারাপ হলেও আপনার সামগ্রিক পোর্টফোলিওতে তার প্রভাব কম পড়বে।
- দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ: স্বল্পমেয়াদী বাজারের উত্থান-পতন এড়িয়ে দীর্ঘমেয়াদে ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ ধরে রাখলে ঝুঁকি কমে এবং ভালো রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
- নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা: নিয়মিতভাবে বাজার এবং অর্থনীতির খবর রাখুন, কোম্পানির পারফরম্যান্স ট্র্যাক করুন এবং আপনার বিনিয়োগ সম্পর্কে অবগত থাকুন।
- স্টপ-লস (Stop-loss) ব্যবহার করা (সক্রিয় ট্রেডারদের জন্য): একটি নির্দিষ্ট লোকসানের পর্যায়ে পৌঁছালে শেয়ারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিক্রি করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রাখলে বড় ধরনের ক্ষতি এড়ানো যেতে পারে।
বিনিয়োগের আগে এই ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত থাকা এবং সেগুলো ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুচিন্তিত কৌশল থাকা অপরিহার্য।
নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ
শেয়ার বাজারে প্রথমবার পা রাখা নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছুটা ভীতি বা দ্বিধা কাজ করা স্বাভাবিক। তবে, কিছু মৌলিক পরামর্শ মেনে চললে এই যাত্রা অনেক সহজ এবং ফলপ্রসূ হতে পারে।
- শেখার উপর সর্বাধিক জোর দিন, রাতারাতি ধনী হওয়ার চিন্তা করবেন না: শেয়ার বাজার কোনো জুয়া খেলা বা দ্রুত টাকা বানানোর স্কিম নয়। এখানে সফল হতে হলে জ্ঞান, ধৈর্য এবং শৃঙ্খলার প্রয়োজন ।
বিনিয়োগ শুরু করার আগে এবং বিনিয়োগ চালিয়ে যাওয়ার সময় ক্রমাগত শেখার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন বই পড়ুন, আর্টিকেল দেখুন, সেমিনারে অংশ নিন এবং বাজার সম্পর্কে নিজের ধারণা তৈরি করুন। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার মানসিকতা পরিহার করুন, কারণ এটি আপনাকে ভুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করতে পারে। - নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী বিনিয়োগ করুন; ধার করে বা অতি প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ করবেন না: শেয়ার বাজারে শুধুমাত্র সেই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করুন যা হারালেও আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বা আর্থিক পরিকল্পনায় বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে না। আপনার জরুরি প্রয়োজনের জন্য জমানো টাকা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার টাকা, বা ধার করা টাকা কখনোই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।
- আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না: শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া (যেমন - দাম বাড়তে দেখে লোভে কেনা, বা দাম কমতে দেখে ভয়ে বিক্রি করা) নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সাধারণ ভুল।
একটি সুচিন্তিত বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং বাজারের স্বল্পমেয়াদী অস্থিরতায় প্রভাবিত না হয়ে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করুন। - একটি সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং তা অনুসরণ করুন: আপনার আর্থিক লক্ষ্য, ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা এবং বিনিয়োগের সময়সীমার উপর ভিত্তি করে একটি ব্যক্তিগত বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করুন। কোন ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবেন, কতদিন ধরে বিনিয়োগ ধরে রাখবেন, কখন লাভ তুলে নেবেন বা লোকসান স্বীকার করবেন – এই বিষয়গুলো আগে থেকেই ঠিক করে নিন।
- প্রয়োজনে অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী বা আর্থিক উপদেষ্টার পরামর্শ নিন: যদি আপনি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা বোধ করেন বা বাজার সম্পর্কে আপনার জ্ঞান সীমিত থাকে, তাহলে কোনো অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত বিনিয়োগকারী বা নিবন্ধিত আর্থিক উপদেষ্টার (financial advisor) পরামর্শ নিতে পারেন । তবে, কারো পরামর্শ অন্ধভাবে অনুসরণ না করে নিজের বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করুন।
- নিয়মিত বাজার এবং অর্থনীতির খবর রাখুন: দেশের এবং আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজার, অর্থনীতি, বিভিন্ন শিল্প খাত এবং আপনি যে কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করেছেন বা করতে চান, সেগুলোর সর্বশেষ খবর এবং তথ্যের প্রতি সজাগ থাকুন । এটি আপনাকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
- ধীরে ধীরে শুরু করুন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করুন: প্রথম দিকে অল্প কয়েকটি ভালো কোম্পানির শেয়ারে অল্প পরিমাণ অর্থ দিয়ে বিনিয়োগ শুরু করুন।
বাজার কীভাবে কাজ করে, দাম কীভাবে ওঠানামা করে, এবং আপনার নিজের বিনিয়োগ কৌশল কতটা কার্যকর তা পর্যবেক্ষণ করুন। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে আপনার বিনিয়োগের পরিমাণ এবং পরিধি বাড়াতে পারেন। - ভুল থেকে শিখুন: শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে গেলে ছোটখাটো ভুল হওয়া স্বাভাবিক। প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং ভবিষ্যতে সেই ভুলগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
এই পরামর্শগুলো নতুন বিনিয়োগকারীদের একটি সুশৃঙ্খল এবং দায়িত্বশীল উপায়ে শেয়ার বাজারে প্রবেশ করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে একটি সফল বিনিয়োগ যাত্রা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
উপসংহার
শেয়ার বাজার বা পুঁজিবাজার নিঃসন্দেহে একটি সম্ভাবনাময় এবং আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ক্ষেত্র। এটি সাধারণ মানুষকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের সঞ্চয় বৃদ্ধি করে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
কোম্পানিগুলো যেমন এই বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটায়, তেমনি বিনিয়োগকারীরাও সেই ব্যবসার সাফল্যের অংশীদার হয়ে লাভবান হতে পারে।
তবে, শেয়ার বাজারে সফল হতে হলে প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান, গভীর বিশ্লেষণ, অসীম ধৈর্য এবং একটি সুশৃঙ্খল বিনিয়োগ পদ্ধতি। এটি কোনো ভাগ্য পরীক্ষার জায়গা নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত খেলা যেখানে তথ্য, বিচক্ষণতা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাজারের উত্থান-পতন থাকবেই; এই অস্থিরতাকে ভয় না পেয়ে, বরং এটিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শেখার আগ্রহ এবং সচেতনতা। না জেনে, না বুঝে, বা গুজবের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করলে লাভের চেয়ে লোকসানের আশঙ্কাই বেশি থাকে।
তাই, বিনিয়োগ শুরু করার আগে এবং বিনিয়োগ চালিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকে বাজার সম্পর্কে আপডেট রাখা, বিভিন্ন বিশ্লেষণ পদ্ধতি শেখা এবং নিজের ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত থাকা অপরিহার্য।
সঠিক পরিকল্পনা, বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কার্যকর কৌশল অবলম্বন করলে শেয়ার বাজার থেকে একটি টেকসই এবং লাভজনক আয় অর্জন করা সম্ভব।
মনে রাখতে হবে, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের একটি উপায় নয়, এটি একটি দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে এবং সামগ্রিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
তাই, আসুন আমরা সচেতন এবং দায়িত্বশীল বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করি এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতেও অংশীদার হই।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন