বাংলা বর্ণমালা: স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা, পরিচয় ও গুরুত্ব

বাংলা ভাষা বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ও মধুর একটি ভাষা। এই ভাষার গঠনশৈলী, ব্যাকরণ এবং উচ্চারণ একে অনন্য করে তুলেছে। বাংলা ভাষার ভিত্তি হলো এর বর্ণমালা। বর্ণমালাকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়: স্বরবর্ণব্যঞ্জনবর্ণ

অনেক সময় স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সঠিক সংখ্যা ও ব্যবহার নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এই আর্টিকেলে আমরা বাংলা বর্ণমালার সঠিক সংখ্যা, পরিচয় এবং গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।

একনজরে বাংলা বর্ণমালা

আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষাবিজ্ঞান অনুযায়ী বাংলা বর্ণমালার মোট অক্ষরের সংখ্যা ৫০টি। একে প্রধান দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে:

  • স্বরবর্ণ (Vowels): ১১টি

  • ব্যঞ্জনবর্ণ (Consonants): ৩৯টি

নোট: অনেক পুরনো বইয়ে স্বরবর্ণের সংখ্যা ৭টি উল্লেখ থাকলেও, আধুনিক প্রমিত বাংলা নিয়ম অনুযায়ী ১১টি স্বরবর্ণই স্বীকৃত।

১. স্বরবর্ণ: সংজ্ঞা ও পরিচিতি

সংজ্ঞা: যে বর্ণগুলো উচ্চারণের সময় অন্য কোনো বর্ণের সাহায্য লাগে না এবং নিজে নিজেই স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হতে পারে, তাদের স্বরবর্ণ বলা হয়।

স্বরবর্ণের তালিকা (১১টি):

অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ।

উচ্চারণভেদে স্বরবর্ণের শ্রেণিবিভাগ:

উচ্চারণের সময়কাল অনুযায়ী স্বরবর্ণকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়:

  • হ্রস্বস্বর (Short Vowels): যাদের উচ্চারণে কম সময় লাগে। (যেমন: অ, ই, উ, ঋ)

  • দীর্ঘস্বর (Long Vowels): যাদের উচ্চারণে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগে। (যেমন: আ, ঈ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ)

২. ব্যঞ্জনবর্ণ: সংজ্ঞা ও পরিচিতি

সংজ্ঞা: যে বর্ণগুলো স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া একা উচ্চারিত হতে পারে না, তাদের ব্যঞ্জনবর্ণ বলা হয়। ব্যঞ্জনবর্ণ মূলত স্বরবর্ণের সাথে যুক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ শব্দ গঠন করে।

ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকা (৩৯টি):

ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, ষ, স, হ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, ঃ, ঁ।

ব্যঞ্জনবর্ণের বৈশিষ্ট্য:

  • এরা স্বাধীনভাবে উচ্চারিত হতে পারে না।

  • শব্দ ও বাক্য গঠনের জন্য এরা অপরিহার্য।

৩. উচ্চারণ স্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনবর্ণের শ্রেণিবিভাগ

বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণগুলোকে তাদের উচ্চারণের স্থান (মুখের কোথায় থেকে উচ্চারিত হয়) অনুযায়ী ৫টি প্রধান বর্গে এবং অন্যান্য ভাগে ভাগ করা হয়। নিচে ছকের মাধ্যমে তা দেখানো হলো:

বর্গের নামউচ্চারণের স্থানবর্ণসমূহ
কণ্ঠ্য বর্ণকণ্ঠ বা গলাক, খ, গ, ঘ, ঙ
তালব্য বর্ণতালুচ, ছ, জ, ঝ, ঞ
মূর্ধন্য বর্ণমূর্ধা (জিহ্বার আগা উল্টে তালুর পেছনের অংশ)ট, ঠ, ড, ঢ, ণ
দন্ত্য বর্ণদাঁতত, থ, দ, ধ, ন
ওষ্ঠ্য বর্ণঠোঁটপ, ফ, ব, ভ, ম
অন্তস্থ ও উষ্ম বর্ণবিভিন্ন স্থানয, র, ল, শ, ষ, স, হ
পরাশ্রয়ী ও অন্যান্য-ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, ঃ, ঁ

৪. স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের গুরুত্ব

বাংলা ভাষার শুদ্ধ গঠন ও উচ্চারণের জন্য এই দুই ধরণের বর্ণের গুরুত্ব অপরিসীম:

  1. শব্দ গঠন: ব্যঞ্জনবর্ণ একা কোনো অর্থপূর্ণ শব্দ তৈরি করতে পারে না, স্বরবর্ণ বা স্বরচিহ্ন (কার) যুক্ত হয়েই শব্দ গঠিত হয়। (যেমন: ক + ল + আ = কলা)।

  2. বানান শুদ্ধি: বাংলা বানানের নিয়ম মূলত স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সঠিক ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল।

  3. উচ্চারণের সৌন্দর্য: কবিতা, গান বা সাহিত্য পাঠে সঠিক উচ্চারণ ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।

৫. সাধারণ বিভ্রান্তি ও সঠিক তথ্য

প্রশ্ন: স্বরবর্ণ ৭টি নাকি ১১টি?

  • সঠিক উত্তর: আধুনিক ব্যাকরণ অনুযায়ী স্বরবর্ণ ১১টি। ভাষাবিজ্ঞানীরা মৌলক স্বরধ্বনি হিসেবে ৭টির কথা বললেও, বর্ণমালায় অক্ষরের সংখ্যা ১১টিই ধরা হয়।

প্রশ্ন: ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৭টি নাকি ৩৯টি?

  • সঠিক উত্তর: প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি। ব-এর দুটি রূপ এবং ড়, ঢ়, য়-এর ব্যবহারের কারণে এই সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলেও ৩৯টিই সঠিক।

৬. সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

১. বাংলা বর্ণমালায় মোট কতটি বর্ণ আছে?

উত্তর: বাংলা বর্ণমালায় মোট ৫০টি বর্ণ রয়েছে (১১টি স্বরবর্ণ + ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ)।

২. স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মূল পার্থক্য কী?

উত্তর: স্বরবর্ণ স্বাধীনভাবে উচ্চারিত হতে পারে, কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণের জন্য স্বরবর্ণের সাহায্যের প্রয়োজন হয়।

৩. ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার কি পরিবর্তন হয়েছে?

উত্তর: ইউনিকোড ও অভ্র কীবোর্ডের কারণে বাংলা লেখা সহজ হয়েছে। তবে অনেক সময় টাইপিংয়ের সুবিধার্থে উচ্চারণে কিছুটা শিথিলতা দেখা যায়, যা সচেতনভাবে এড়িয়ে চলা উচিত।

উপসংহার

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ হলো বাংলা ভাষার মেরুদণ্ড। তাই শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখার জন্য বর্ণমালার সঠিক সংখ্যা, উচ্চারণ এবং ব্যবহারের নিয়ম জানা অত্যন্ত জরুরি।

আপনার যদি এই বিষয়ে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নিচে মন্তব্য করে জানাতে পারেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন