অনেকদিনের শখ বা প্রয়োজনের পর একটি নতুন স্মার্টফোন হাতে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। বক্স খোলার উত্তেজনা, নতুন ফোনের চকচকে ডিজাইন আর আধুনিক ফিচারের হাতছানি—সবকিছু মিলিয়ে এক দারুণ অনুভূতি।
কিন্তু এই আনন্দের মাঝেই আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে ফেলা উচিত, যা আপনার নতুন ফোনের নিরাপত্তা, পারফরম্যান্স এবং দীর্ঘস্থায়ীত্ব নিশ্চিত করবে।
অনেকেই নতুন ফোন কেনার পর শুধু সিম কার্ড ঢুকিয়েই ব্যবহার শুরু করে দেন। কিন্তু এর বাইরেও কিছু করণীয় রয়েছে যা আপনার ভবিষ্যৎ ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাকে অনেক মসৃণ করে তুলবে।
এই আর্টিকেলে আমরা ধাপে ধাপে জানব নতুন ফোন কেনার পর আপনার কী কী করা উচিত।
১. বক্স এবং ভেতরের জিনিসপত্র পরীক্ষা করুন
ফোন চালু করার আগে বক্সটি ভালোভাবে পরীক্ষা করুন। নিশ্চিত হোন যে বক্সের সিলটি অক্ষত ছিল। এরপর বক্স খুলে ভেতরের সব অ্যাক্সেসরিজ ঠিকঠাক আছে কিনা মিলিয়ে নিন:
হ্যান্ডসেট (মূল ফোন)
চার্জার (অ্যাডাপ্টার)
ডেটা ক্যাবল (USB Cable)
সিম ইজেক্টর পিন
ওয়ারেন্টি কার্ড ও ব্যবহার নির্দেশিকা (User Manual)
অনেক সময় ফোনের সাথে একটি বেসিক কেস বা স্ক্রিন প্রোটেক্টরও দেওয়া থাকে।
যদি কোনো কিছু অনুপস্থিত বা ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়, তবে দ্রুত বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করুন।
২. ফোনটি সম্পূর্ণ চার্জ দিন
বক্স থেকে বের করার পর ফোনে সাধারণত ৪০-৫০% চার্জ থাকে। ফোন ব্যবহার শুরু করার আগে এটিকে অরিজিনাল চার্জার দিয়ে ১০০% পর্যন্ত সম্পূর্ণ চার্জ করে নিন। এটি ব্যাটারির ক্যালিব্রেশন সঠিক করতে সাহায্য করে এবং ব্যাটারির দীর্ঘস্থায়ীত্বের জন্য একটি ভালো সূচনা।
৩. সিম কার্ড এবং মেমোরি কার্ড প্রবেশ করান
সিম ইজেক্টর পিনের সাহায্যে সিম ট্রে বের করে আপনার সিম কার্ডটি সঠিক স্লটে স্থাপন করুন। যদি আপনার ফোনে অতিরিক্ত মেমোরি কার্ড (SD Card) ব্যবহারের সুযোগ থাকে এবং আপনার প্রয়োজন হয়, তবে সেটিও একই সাথে প্রবেশ করান।
৪. ফোন চালু করুন এবং প্রাথমিক সেটআপ সম্পন্ন করুন
এবার ফোনটি চালু করুন। পাওয়ার বাটন চেপে ধরলে ফোনের ব্র্যান্ড লোগো দেখতে পাবেন। এরপর আপনাকে কিছু প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করতে হবে:
ভাষা নির্বাচন: আপনার পছন্দের ভাষা (যেমন - বাংলা বা ইংরেজি) নির্বাচন করুন।
ওয়াই-ফাই সংযোগ: একটি স্থিতিশীল ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে ফোনটি সংযুক্ত করুন। সিস্টেম আপডেট এবং অ্যাপ ডাউনলোডের জন্য এটি জরুরি।
গুগল অ্যাকাউন্টে সাইন ইন: আপনার পুরনো জিমেইল আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন। এটি আপনার কন্টাক্ট, ইমেইল, গুগল ড্রাইভের ফাইল এবং অন্যান্য ডেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিঙ্ক করে দেবে। যদি আপনার গুগল অ্যাকাউন্ট না থাকে, তবে একটি নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করে নিন।
ডেটা ট্রান্সফার: আপনি যদি পুরনো অ্যান্ড্রয়েড ফোন থেকে নতুন ফোনে আসেন, তবে গুগল আপনাকে পুরনো ফোনের অ্যাপ, কন্টাক্ট, মেসেজ ইত্যাদি সহজে ট্রান্সফার করার সুযোগ দেবে। ‘Copy apps & data’ অপশনটি ব্যবহার করে আপনি ক্যাবল বা ওয়্যারলেসভাবে ডেটা ট্রান্সফার করতে পারবেন।
৫. নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন: স্ক্রিন লক এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেট করুন
আপনার ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সেটিংসে গিয়ে একটি শক্তিশালী স্ক্রিন লক সেট করুন। আপনি প্যাটার্ন, পিন বা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে পারেন। এর পাশাপাশি, ফেস আনলক (Face Unlock) এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর (Fingerprint Sensor) সেট করে নিন। এটি ফোনকে দ্রুত আনলক করতে এবং অ্যাপ বা পেমেন্টের জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তা দিতে সাহায্য করবে।
৬. সিস্টেম এবং অ্যাপ আপডেট করুন
ফোনটি যখন তৈরি হয়েছে এবং আপনার হাতে এসেছে, এর মধ্যে বেশ কিছুটা সময়ের ব্যবধান থাকে। এই সময়ে ফোনের অপারেটিং সিস্টেমের জন্য নতুন আপডেট বা সিকিউরিটি প্যাচ এসে থাকতে পারে।
সিস্টেম আপডেট: Settings > About Phone > System Update এ গিয়ে সর্বশেষ আপডেটটি ডাউনলোড এবং ইনস্টল করুন। এটি ফোনের পারফরম্যান্স, নিরাপত্তা এবং বাগ ফিক্সের জন্য অপরিহার্য।
অ্যাপ আপডেট: গুগল প্লে স্টোরে গিয়ে ‘My apps & games’ থেকে আগে থেকে ইনস্টল থাকা সব অ্যাপ আপডেট করে নিন।
৭. অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ (Bloatware) আনইন্সটল বা ডিজেবল করুন
ফোন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো অনেক সময় তাদের নিজস্ব কিছু অ্যাপ প্রি-ইনস্টল করে দেয়, যার বেশিরভাগই আমাদের কোনো কাজে আসে না। এই অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলোকে ব্লোটওয়্যার (Bloatware) বলা হয়। এগুলো ফোনের স্টোরেজ এবং র্যাম দখল করে রাখে।
যেসব অ্যাপ আনইন্সটল করা যায়, সেগুলো সরাসরি আনইন্সটল করে দিন। আর যেগুলো আনইন্সটল করা যায় না, সেগুলোকে সেটিংসের অ্যাপস মেন্যু থেকে ‘Disable’ বা ‘Force Stop’ করে রাখুন।
৮. প্রয়োজনীয় অ্যাপ ইনস্টল করুন
এবার আপনার দৈনন্দিন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাপগুলো প্লে স্টোর থেকে ইনস্টল করার পালা। যেমন - সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম), ব্যাংকিং অ্যাপ, রাইড শেয়ারিং অ্যাপ, এডিটিং টুলস ইত্যাদি। তবে অচেনা বা উৎস থেকে কোনো অ্যাপ (APK ফাইল) ইনস্টল করা থেকে বিরত থাকুন।
৯. ডিসপ্লে এবং নোটিফিকেশন কাস্টমাইজ করুন
আপনার স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী ফোনের ডিসপ্লে সেটিংস ঠিক করে নিন। যেমন - ডার্ক মোড চালু করা, ফন্টের আকার পরিবর্তন করা, স্ক্রিন টাইমআউট সেট করা ইত্যাদি। এছাড়া, অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন ম্যানেজ করুন। যে অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন আপনার প্রয়োজন নেই, সেগুলো বন্ধ করে দিন যাতে অপ্রয়োজনীয় আপনি বিরক্ত না হন।
১০. ফোনের যত্ন নিন: স্ক্রিন প্রোটেক্টর ও কেস ব্যবহার করুন
নতুন ফোনের সুরক্ষার জন্য একটি ভালো মানের স্ক্রিন প্রোটেক্টর (টেম্পার্ড গ্লাস) এবং একটি মজবুত ব্যাক কেস বা কভার ব্যবহার করুন। এটি আপনার ফোনকে স্ক্র্যাচ, দাগ এবং দুর্ঘটনাবশত পড়ে যাওয়ার আঘাত থেকে সুরক্ষিত রাখবে।
১১. ‘Find My Device’ ফিচারটি চালু রাখুন
এটি গুগলের একটি চমৎকার সার্ভিস। Settings > Security > Find My Device এ গিয়ে এই অপশনটি চালু রাখুন। যদি আপনার ফোন কখনো হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তবে এই ফিচারের মাধ্যমে আপনি অন্য কোনো ডিভাইস থেকে আপনার ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করতে পারবেন, ফোন লক করতে পারবেন বা ডেটা মুছে ফেলতে পারবেন।
উপসংহার
একটি নতুন ফোন কেনা একটি বিনিয়োগের মতো। আর এই বিনিয়োগকে দীর্ঘস্থায়ী এবং মসৃণ করতে উপরের ধাপগুলো অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই কাজগুলো সম্পন্ন করতে হয়তো আপনার কিছুটা সময় লাগবে, কিন্তু এটি নিশ্চিত করবে যে আপনার নতুন স্মার্টফোনটি প্রথম দিন থেকেই সেরা পারফরম্যান্স এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান করবে। আপনার নতুন ফোন ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আনন্দদায়ক হোক!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন